দুই কোটি ৮৬ লাখ টাকা লোকসান দেওয়ার পরে কনফিডেন্স গ্রুপের সফলতার গল্প!

‘ব্যর্থতা জীবনের অংশ। প্রথম যে ব্যবসা শুরু করি, সেখানে আমি দুই কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান দেই। এটা ছাড়াও আরো অনেক লস আমি করেছি। ব্যবসা করতে হলে মনে রাখতে হবে সাফল্য-ব্যর্থতা থাকবেই। ব্যবসায় ব্যর্থতাকে গ্রহণ করতে হয় এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হয়।’ কথাগুলো বলেছেন কনফিডেন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান করিম।

যুক্তরাষ্ট্রের রোচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে ইলেক্ট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অর্থনীতিতে অনার্স করেছেন। তবে তিনি চাকরি-বাকরির কোনো চেষ্টাই করেননি। ব্যবসাই করতে চেয়েছেন। শুরুতেই ব্যর্থতার দেখা মেলে। তবে তাতে দমে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসেনি তাঁর। তাই সব ভুলে সামনে এগিয়ে গেছেন। বেড়েছে ব্যবসা। বিয়ে করেছেন বছর দশেক হলো। স্ত্রী চিকিৎসক। অফিসের পর তিনি বাইরে না থেকে বাসাতেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা জমান। আড্ডাতে থাকেন স্বজনরাও।

তাঁর বাবা রেজাউল করিম ছিলেন প্রকৌশলী। আর মা ইফাত করিম চিকিৎসক। তিন ভাইও যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। এক ধরেনের পেশাদার মনোভাব রয়ে গেছে তাঁর পরিবারের সবার মধ্যে। আর এই শিক্ষাটা তাঁরা তিন ভাই পেয়েছেন মা-বাবার কাছ থেকে। পড়াশোনায় তাঁদের কোনো ছাড় ছিল না। সাথে নানান কাজে মানসিক শক্তিটাও জুগিয়ে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর মায়ের কথা একটু আলাদা করেই বলতে হয়। কারণ সেই আমলে ডাক্তারি পাস করেছেন যিনি, তিনি তো চাইলে আরো অনেক কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু সবকিছুই নাকি বাদ দিয়েছেন সন্তানদের কথা ভেবে।

খাবার-দাবারের বেলায় অনেকটা এক কথায়ই বলা যায়, তারা সবাই খুব ভোজন রসিক। গরুর মাংসটা তাদের পরিবারের সবার প্রিয় খাবার। ইতালীয়ান খাবারগুলোও ভালোই লাগে। পোশাক আশাকের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে পাজামা-পাঞ্জাবি। তবে প্রয়োজনে স্যুট-টাই পরতেই হয়। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ইমরান করিমের ফলাফল ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল যে করেই হোক ছেলেকে দেশের বাইরে পড়াবেন। সে ইচ্ছাটা তিনি পূরণ করেছেন। তবে ছেলে দেশের বাইরে থাকুক সেটা চাননি কখনোই। তেমনটা হয়ওনি। পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ইমরান করিম। আর তাঁর বাবা কখনোই সন্তানদের নিজের গণ্ডিতে আটকে রাখতে চাননি। তাঁদের মতো করে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। ফলাফলটা তো এখন নিজের চোখেই দেখছেন। প্রিয় সন্তানরা আরো সফলতা পাক, সেই কামনাও তাঁর সব সময়ের।

তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজ সব ঢাকাতেই। তারপর চলে যান আমেরিকাতে। সেখানে নেন উচ্চতর ডিগ্রি। তবে আমেরিকার নয়, তাঁর স্কুলজীবনের নাকি একটা বড় প্রভাব আছে তাঁর জীবন চলার পথে। পড়াশোনা শেষ করেই ব্যবসায় নেমে পড়েন তিনি। চাকরিতে যে তাঁর মন টিকবে না তাও বুঝে গিয়েছিলেন তখনই। তাই আর সেদিকে পা বাড়াননি। বাবার হাত ধরে যে ব্যবসার গোড়াপত্তন ঘটেছিল, তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর নিজের মেধা আর পরিশ্রমে সেটিই টেনে এনেছেন বহু দূর। ব্যবসার প্রসার হয়েছে, প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। এখন যারা ব্যবসায় আসতে চান তাঁদের আগে লক্ষ্যটা ঠিক করার পরামর্শ তাঁর। তারপর পরিশ্রম, ধৈর্য আর সাহস- এই তিন গুণে এগিয়ে যেতে হবে। শুরুতেই কেউ যদি টাকা টাকা করতে থাকে তবে তার জন্য ব্যবসাটা কঠিন হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন, সবার সেটাই করা উচিত, যার যেটায় মন বসে।

যদি কেউ আর্টিস্ট হতে চায়, তাকে আর্টিস্টই হওয়া উচিত। একজন যদি চিন্তা করে, আমি ক্রিকেটার হবো- তাকে তাই হওয়া উচিত। কেউ একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় তাকে মা-বাবা জোর করে ডাক্তার বানিয়ে দিলেন। যে ডাক্তার হতে চায় তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে দিলেন। সবার জন্য সব কিছু নয়। সবাইকে দিয়ে সব কিছু হতে হবে, এমন ভাবার অবকাশ নেই। তা না হলে সমাজে এত পেশাদার থাকত না। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ব্যবসা যদি কেউ করতে চায় তাকে মনে রাখতে হবে, একটি সুন্দর ধারণা ব্যবসায় মূল্য দেবেই। যদি কেউ মনে করে ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য করে, তাহলে অবশ্যই সে ভুল করবে। ব্যবসায় ব্যর্থতা অনিবার্য। ব্যবসার মধ্যে গভীর আসক্তি থাকতে হবে। আপনি যে নতুন নতুন কাজ করবেন সেই কাজগুলোর মধ্যে আসক্তি থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যে যদি পৌঁছাতে পারেন, অর্থ এমনিতেই আসবে। আপনি যাই করেন না কেন, সেখানে আপনাকে উৎকৃষ্টতার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

সুন্দর ধারণাকে লালন করতে হবে। স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস থাকতে হবে। পরিশ্রম, অনুরাগ ও নিষ্ঠা থাকতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায় কখনো সফলতা আনা সম্ভব নয়। ব্যর্থতা থাকবেই, সেটার জন্য ভেঙে পড়লে ব্যবসায় সাফল্য আসবে না। অনেকে মনে করে ব্যবসার জন্য অর্থায়ন প্রয়োজন, কিন্তু ইমরান তা মনে করেন না। তাঁর মতে, অর্থায়ন আসবেই। যদি সুন্দর ধারণা থাকে, কঠোর পরিশ্রম করা হয় এবং ব্যর্থতা থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগানো হয়। যদি ব্যবসার ক্ষেত্রটা সেভাবে গুছিয়ে নেওয়া যায়। তাহলে আর অন্য কোনো কিছু করার দরকার হবে না।

সিমেন্ট দিয়ে তাঁদের ব্যবসার শুরু। পরে যা আরো বেড়েছে। সব মিলিয়ে ব্যবসায় এখন ফি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন তাঁদের। সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীও আছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার। কনফিডেন্স গ্রুপ ছয়টি পৃথক ব্যবসা করে। প্রাথমিকভাবে সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে পরিচিত। তাঁদের প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড। বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ খাতেও ব্যবসা আছে। তাঁদের ব্যবসা দেশের বাজারে যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের বাইরেও। তাদের অনেক পণ্য দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়। আবার ভারতের সাথে যৌথভাবেও ব্যবসা করেন তাঁরা। ৩০ ভাগ রপ্তানি থেকে আয় আসে। আর বাকিটা দেশে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি আরেকটু এগিয়ে আসত, তাহলে দেশের বাইরে বাংলাদেশি পণ্যের আরো প্রসার ঘটত বলেও বিশ্বাস তাঁর।

ইমরানের মতে, বাংলাদেশ গভীর উপলব্ধি সংকটে ভুগছে। দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার খপ্পরে ২০০৮ সালে পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন- গ্রিস ধনী থেকে গরিব হয়ে গেছে। তবে এ দেশের অর্থনীতি পড়ে যায়নি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভালো করছি আমরা। আমি মনে করি, ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দরকার যথাযথ উপস্থাপন। বিদেশে সরকারের পক্ষ থেকে, সবার পক্ষ থেকে ব্র্যান্ডিং করার প্রয়োজন আছে।

About admin

Check Also

ছবিতে লুকিয়ে আছে ভালুক, দেখুন খুজে পান কিনা.

মাঝেমাঝেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় দৃষ্টিবিভ্রম বা ‘অপটিক্যাল ইলিউশনের’ ছবি। এই ধরনের ছবিগুলি সাধারণত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *